তোমরা প্রতিদিন কোরআন মাজীদ পড়ো না? সে-কী! আজ থেকে পড়বে। আমাদের প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআন পড়েছেন। আল্লাহ তায়ালা নবিজিকে শিখিয়েছেন। মহান ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালাম এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। হ্যাঁ, এইতো এই পৃথিবীতে। তিনি এসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন কোরআন মাজীদের আয়াতগুলো।
তোমাদের জানতে ইচ্ছে করে না— কীভাবে কোরআন এসেছিলো এই পৃথিবীতে? আজ তোমাদের সেই ঘটনাই বলব। নড়েচড়ে বসো তো খানিক। পবিত্র সেই ঘটনা। মন দিয়ে শোনো—
আমাদের প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও সাধারণ মানুষ। সবার প্রিয় মানুষ। মক্কার সবাই পছন্দ করতো তাকে।
তিনি মিথ্যা বলতেন না।
কাউকে কষ্ট দিতেন না।
সবার উপকার করতেন।
সবার আমানত রক্ষা করতেন।
আর তোমাদের মতো কোমলমতি শিশুদের তিনি খুউব বেশি ভালোবাসতেন।
হঠাৎ একদিন হলো কী— নবিজি একটি স্বপ্ন দেখলেন। তা তো সবাই দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্নটি ছিল সত্য। একেবারে দিনের আলোর মত সত্য! সত্য একটি স্বপ্ন দেখে তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। এভাবে বেশ কয়েকবার তিনি সত্য স্বপ্ন দেখলেন।
ধীরে ধীরে তার মাঝে পরিবর্তন আসতে লাগল। তিনি চুপচাপ হয়ে গেলেন। একাকী থাকতে পছন্দ করলেন। আচমকা একদিন তিনি ঘর ছেড়ে চলে গেলেন! দেখো তো কী কাণ্ড! নবিজির স্ত্রী হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা দুঃখ পেলেন। মনে নিরব শঙ্কা! আহা! আমার দ্বারা কোন ভুল হয়ে গেলো কি না। কোথায় চললেন প্রাণের চেয়ে প্রিয় মানুষটি! কোথায় হারালেন আমার চোখের তারা!
মক্কায় ছিল এক পাহাড়। সেই পাহাড়ে ছিল এক গুহা।
নিরব।
নিশ্চুপ।
কোথাও কেউ নেই।
সেই পাহাড়ের গুহায় গিয়ে উঠলেন নবিজি। নিরিবিলি পরিবেশে তিনি ইবাদত-বন্দেগি শুরু করলেন। রাত নেমে এলে তিনি ঘরে ফিরে এলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। আম্মাজান খাদিজার মনে মৌন আনন্দ। আমার চোখের মণি, আমার দিলের স্পন্দন ফিরে এসেছেন!
এরপর থেকে নবিজি প্রতিদিনই সেই গুহায় গিয়ে একাকী ইবাদত করতেন। সঙ্গে খাবার নিয়ে যেতেন। মাঝেমাঝে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা গিয়ে খাবার দিয়ে আসতেন। এভাবেই চলতে লাগল দিনকাল।…
এরপর একদিন…!
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই গুহাতেই ছিলেন। ইবাদত করছিলেন। হঠাৎ কী হলো! ছমছমে হয়ে উঠল পরিবেশ। নবিজি ভয় পেলেন। ধীরে ধীরে অদ্ভুত সুন্দর এক অবয়ব প্রকাশ পেলো। হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম। তিনি এসেই স্বর্গ-মর্ত্যের বাইরের ভিন্ন এক সুরে বললেন, “পড়ুন।”
আমাদের নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভয় পেলেন। কিন্তু পিছু হটলেন না। ছোট আওয়াজে স্পষ্ট করে বললেন, “আমি পড়তে জানি না।”
ফেরেশতা নবিজিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলেন। খুব শক্ত করে। নবিজি খুব ব্যথা পেলেন! মুহূর্ত পরেই তিনি নবিজিকে ছেড়ে দিলেন। সুন্দর করে বললেন, “পড়ুন।”
নবিজির মনে শঙ্কা। অজানা এক শঙ্কা। কী হবে এবার! আরো খানিকটা ছোট আওয়াজে বললেন, “আমি পড়তে জানি না।”
জিবরাইল আলাইহিস সালাম আবার বুকের সাথে চেপে ধরলেন তাকে। সেই একই শক্তিতে। সেই একইরকম জোরে। তারপর ছেড়ে দিলেন। নবিজিকে বললেন, “পড়ুন।”
নবিজি একই জবাব দিলেন, “আমি পড়তে জানি না।”
আবার জিবরাইল আলাইহিস সালাম নবিজিকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। এবারও নবিজি খুব ব্যথা পেলেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে— যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।…” একে একে সুরা আলাকের প্রথম পাঁচখানা আয়াত পড়ে তিনি থামলেন।
নবিজি ভয় পেলেন। কাঁধের মাংস থরথর করে কাঁপছিল। আয়াত পাঁচটি বুকে নিয়ে তিনি ঘরে ফিরে এলেন। প্রিয়তমা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, “খাদিজা! আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।”
চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল নবিজিকে। বেশ খানিক পর নবিজির ভয় দূর হল। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, “আমার সাথে এসব কী হচ্ছে খাদিজা? আমি নিজের ওপর প্রচণ্ড ভীতি অনুভব করছি।” — খাদিজার কাছে সব খুলে বললেন নবিজি। কিচ্ছু বাদ রাখলেন না।
সব শুনে বুদ্ধিমতী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবিজিকে অভয় দিলেন। মিষ্টি আওয়াজে বললেন, “ওগো! আপনার কোন ক্ষতি হবে না। কখনোই না। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে বিন্দুমাত্র লাঞ্ছিত করবেন না।
আপনি আত্মীয়দের খোঁজ-খবর নেন।
সত্য কথা বলেন।
অসহায় লোকদের সাহায্য করেন।
নিঃস্ব লোকদের উপার্জন করে দেন।
মেহমানদের আপ্যায়ন করেন।
সত্যের পথে থাকা লোকদের বিপদে সহায়তা করেন।”
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ছিল এক চাচাতো ভাই। ওয়ারাকা বিন নওফাল। জাহেলি যুগে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আরবীতে কিতাব লিখতেন। ইনযিলের আরবি অনুবাদ করতেন। তিনি খুব বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ওয়ারাকা বিন নাওফাল ছিলেন খুউব জ্ঞানি ব্যক্তি। নবিজিকে নিয়ে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছে এলেন। তাকে বললেন, “হে আমার চাচাতো ভাই! দেখুন তো আপনার ভাতিজা কী বলছে?”
ওয়ারাকা নবিজিকে বললেন, “বলো ভাতিজা! কী দেখেছো তুমি?”
নবিজি সব খুলে বললেন ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছে। ওয়ারাকা আশ্চর্য হয়ে গেলেন! মুখে তার এক পশলা দুঃখ। আক্ষেপ করে বললেন, “ইনি তো সেই ফেরেশতা, যিনি মূসা আলাইহিস সালামের কাছে আসতেন! হায়! সে দিনটিতে যদি আমি যুবক থাকতাম। হায়! সে দিনটিতে যদি আমি বেঁচে থাকতাম!”
অবাক হলেন নবিজি, “কোন দিনের কথা বলছেন আপনি?”
ওয়ারাকা একটি রহস্যের জট খুললেন। বললেন, “মক্কাবাসীরা আপনাকে দেশ থেকে বের করে দিবে!”
নিষ্পাপ চেহারায় নবিজি প্রশ্ন করলেন, “ওরা কি সত্যিই আমাকে বের করে দিবে?”
ওয়ারাকা বললেন, “হ্যাঁ। যারাই এই সত্য বাণী নিয়ে এসেছে, তাদের সবাইকে কষ্ট দিয়েছে লোকেরা। যদি আমি সেই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তাহলে তোমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।”
কিন্তু ওয়ারাকা বিন নাওফাল সেই দিন পর্যন্ত বাঁচেননি। কিছুদিন পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
এটি ছিল নবিজির ওপর প্রথম ওহি নাযিলের ঘটনা। পবিত্র কোরআন মাজীদ অবতীর্ণ হওয়ার সূচনা। এরপর বেশ কিছুদিন ওহি এলো না। এতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।
যা ভাবলাম, যা শিখলাম
১. নবিদের স্বপ্নগুলো সত্য হয়।
২. কোরআন নাযিলের আগে নির্জনে ইবাদত করার দ্বারা নবিজির অন্তর বিশুদ্ধ করা হয়েছিল। তারপর কোরআন অবতীর্ণ হয়।
৩. তিন তিনবার জিবরাইল আলাইহিস সালাম বলেছিলেন “পড়ুন”। ভেবে দেখো, কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এই কোরআন!
৪. কোরআন মাজীদের প্রথম আয়াতখানাই হল, “পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।” তাই কোরআন পাঠ করার অনেক গুরুত্ব।
৫. খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা কতো ভালো স্ত্রী ছিলেন। মেয়েদের জন্য অনুসরণীয়। নবিজি যখন ভয় পেলেন, তখন তিনি কতো মিষ্টি সুরে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন!
৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।
৭. দুর্বল লোকদের উপার্জন করে দেওয়া ভালো কাজ।
৮. অসহায়কে সাহায্য করা উচিত।
৯. মেহমানদের আপ্যায়ন করতে হবে।
১০. সত্যের পথে থাকা মানুষের বিপদে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব।
১১. ইসলামের পূর্ব-যুগ ছিল জাহিলিয়ার যুগ। তখনকার মানুষ ছিল ঘোরপাপী।
১২. প্রত্যেক নবিই দীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে কষ্ট সয়েছেন। আমাদের নবিও কষ্ট সয়েছেন। তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি মক্কা বিজয় করেছিলেন।
শপথ —
এসো আমরা হাতে হাত রেখে শপথ করি—
প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করব। অযু ছাড়া কোরআন স্পর্শ করব না। উপরিউক্ত শিক্ষাগুলো গ্রহণ করব। আর মেয়েরা সবাই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মত হবো। আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন।
(বুখারি ৪৯৫৩)
অসাধারণ শিশুতোষ লিখনী। প্রতিটি শিশু-কিশোরই মজা পাবে পড়তে। সাথে পাবে সুন্দর কিছু শিক্ষা। কুরআনের প্রতি তাদের অনুরাগ-ভালোবাসাও তৈরি হবে। এরকম আরও লেখা প্রত্যাশা করি লেখকের কাছে!
জাযাকাল্লাহ।
💕