স্পর্শকাতর বিষয়গুলো চিরকালই স্পর্শকাতর। এগুলো থেকে আমাদের সজাগ দূরত্ব রেখেই চলা কাম্য। তেমন একটি বিষয় হল মাকাসিদে শরিয়াহ। আজকাল অহরহই এর অপব্যবহার দেখা যায়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, কিছু লোক নিজেদের পক্ষ থেকে আহকামে শরিয়ার বিভিন্ন কারন, উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ আবিস্কার করে এবং সেটাকেই চূড়ান্ত ভাবে। শুধু তাই নয় বরং তারা ভাবে উপরোক্ত হুকুমটি হওয়া কিংবা না হওয়া নির্ভর করে সেই ইল্লত বা কারন পাওয়া অথবা না পাওয়ার ওপরে। ফলে তারা নিজেদের মনগড়া ধারনা অনুযায়ী শরিয়তের স্পষ্ট বিধানগুলোকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে বসে। উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। যেমন—
কিছু মানুষের থেকে আমি এমনটা শুনেছি যে, তারা বলে বেড়ায় ওজুর উদ্দেশ্য হচ্ছে পবিত্রতা অর্জন করা। আর তা ওজু ছাড়া ভিন্নভাবেও অর্জন করা যায়। কাজেই প্রকৃতপক্ষে ওজুর তেমন কোন জরুরত নেই। এক পর্যায়ে (আল্লাহ্ মাফ করুন) তাদের কেউ কেউ তো ওজু ছাড়া নামাজও পড়তে শুরু করে!
আর কেউ কেউ তো এই কথা বলে সালাত তরক করতে থাকে যে, সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাহজিবুল আখলাক বা চরিত্র সংশোধন। (আর তা সালাত ছাড়া ভিন্নভাবে ও সম্ভব, কাজেই সালাত ত্যাগে সমস্যা নেই!)
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এক পর্যায়ে তারা সালাত, সিয়াম, জাকাত, হজ্ব এর মত আল্লাহর অনেক আদেশ পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে ফেলে। বদলে ফেলে আল্লাহর অনেক নিষেধও! যেমন, সুদ, ফটোসেশন ইত্যাদি। এক পর্যায়ে তারা বিকৃত করে ফেলে পুরো শরিয়তকেই। — যা সুস্পষ্ট ইলহাদ।
শরীয়তের বিধানের পিছনে তাদের এই দাবিগুলো সম্পূর্ণরূপে বাতিল। কুরআন-সুন্নাহয় এগুলোর কোন স্থান নেই। এটা কি অসম্ভব যে, শরিয়তের এতোসব বিধি-নিষেধ শুধুমাত্র ইবাদতের উদ্দেশ্যেই প্রনয়ণ করা হয়েছে। এবং এসব হুকুম আহকাম দ্বারা আল্লাহ্ তায়ালার উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাকে পরীক্ষা করা।
উপরন্তু বিভিন্ন আহকাম সম্পর্কে তাদের নব উদ্ভাবিত উদ্দেশ্য, যাকে তারা একমাত্র এবং চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বলে জ্ঞান করে থাকে, খোদ এই দাবীর পক্ষেও তাদের কাছে কোন দলিল নেই । আমরা অস্বীকার করছি না যে, শরিয়ার আহকামের কোন মাকাসিদ হতে পারেনা। হ্যাঁ আমরাও বলি, শরিয়তের আহকামের বিভিন্ন মাকাসিদ হতে পারে। তবে সেই উদ্দেশ্য একমাত্র এবং চূড়ান্ত নয়।
সাথে এই সম্ভবনাও আছে যে, উদ্ভাবিত উদ্দেশ্যটি আসল মাকসাদের কোন একটা বিশেষ দিক মাত্র। যা বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় আলোচনায় আসতে পারে। যেমন কোন কোন ওষুধের নানা কার্যকারিতা থাকা সত্ত্বেও তার বিশেষ একটা দিক থাকে।
এমন কিছু ঘটার সম্ভবনাও ফেলে দেওয়া যায় না যে, কোন একটি হুকুমের একটি উদ্দেশ্য একজন আবিস্কার করল, ঠিক একই হুকুমের ভিন্ন আরেকটি উদ্দেশ্য আরেকজন বের করল। অর্থাৎ যার যার বুঝ এবং ফাহম অনুযায়ী সে উদ্দেশ্য বের করল। এমতাবস্থায় কার উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হবে? আর প্রাধান্যের মাপকাঠিই বা কী হবে? অথচ নিয়ম অনুযায়ী এমতাবস্থায় দুটো উদ্দেশ্যই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কারন মূলনীতি হল ‘ইজা তাআরজা তাসাকতা’। অর্থাৎ দুটো বিষয় পরস্পর সাংঘর্ষিক হয়, তখন উভয়টিই বাতিল হয়ে যায়।এখন যদি তাদের বানানো উদ্দেশ্যকেই একমাত্র ধরে নেওয়া হয় তাহলে তাদের উদ্দেশ্য বাতিল হওয়ার কারনে আসল হুকুমটাও বাতিল হয়ে হবে। প্রিয় পাঠক আপনিই বলুন, কোন জ্ঞানি, দীনদরদী মানুষের পক্ষে কি এমনটা বলা সম্ভব?
এই মাকাসিদের অপব্যবহারের একটি ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, কিছু মানুষ অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে শরিয়ার বিভিন্ন শাখাগত বিষয় সাব্যস্ত করতে গিয়ে এইসব মাকাসিদকে দলিল হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। অথচ এটি মস্ত বড় ভুল এবং বিরাট ভ্রান্তি। কেননা এইসব ইল্লত ধরে নেওয়া উদ্দেশ্য মাত্র। কখনো যদি এইসব নব উদ্ভাবিত ইল্লতের মধ্যে কোন সন্দেহ-সংশয় দেখা দেয়, তাহলে মূল হুকুমেও দেখা দিবে সন্দেহ। যা ভিন্ন ধর্মের লোকদের জন্য এক মহা বিজয় এবং আহকামে শরিয়াহ বাতিলের মহা সুযোগও বটে!
মোটকথা, আহকামে শরিয়াহ হল আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বেধে-দেওয়া সুনির্ধারিত কিছু নিয়ম। সুতরাং নিজেদের মনগড়া মাকাসিদ আর ইল্লতের দোহাই দিয়ে এসব অকাট্য নিয়মকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার অধিকার কারো নেই। এই অধিকার একমাত্র শরিয়াহ প্রবর্তকেরই রয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, মুজতাহিদ ইমামগন কিছু কিছু আহকামের ক্ষেত্রে যেসব ইল্লত বের করেছেন, তা দ্বারা কেউই শরিয়তের কোন আহকাম পরিবর্তন করেননি এবং কেউ ধোঁকাও খায়নি। তাছাড়া তখন এটার বিশেষ প্রয়োজনও ছিল। কারন মানুষের অত্যধিক প্রয়োজন থাকায় হুকুমটি অবর্ণিত বিষয়সমূহে প্রয়োগ করা ছিল জরুরি।
উপরন্তু তারা ছিলেন ইলমে নববীর দক্ষ সৈনিক, সজাগ নাবিক। আর আমাদের না আছে তেমন প্রয়োজন আর না আছে ইলমের গভীরতা। কোনটাই আমাদের নেই। তাছাড়া প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং ইলমের কমতি তো মূল মাকাসিদ জানার পথে বিরাট অন্তরায়। কাজেই আমাদেরকে মাকাসিদের অপব্যবহার থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ তাউফিক দান করুন। আমিন।
সূত্রঃ আল ইনতিবাহাতুল মুফিদাহ ফি হাল্লিল ইশতিবাহাতিল জাদিদাহ, পৃষ্ঠা, ১১৫-১৭
মূলঃ হাকীমুল উম্মাত আশরাফ আলী থানবি রহিমাহুল্লাহ
অনুবাদঃ কায়েস শরীফ