অনেক আলিমই শরিয়াহর বিধানসমূহের উপকারিতা (মাসালিহ) এবং তার উদ্দেশ্য (মাকাসিদ) নিয়ে কিতাব রচনা করেছেন। তাদের এসব আলোচনার উদ্দেশ্য কখনো এটা ছিলো না যে, শরিয়ার বিধানগুলো কেবল এসব উপকারিতা ও উদ্দেশ্যের মাঝে সীমাবদ্ধ, শর’য়ী নসের কোন ধর্তব্য নেই। বরং তাদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিলো এ কথা বোঝানো যে, শরিয়ার এমন কোন বিধান নেই যা দীন অথবা দুনিয়ার উপকারীতা থেকে শূন্য এবং যে সকল ক্ষেত্রে শরয়ি নস অনুপস্থিত ও যে সকল বিষয় মুবাহ পর্যায়ের সে সকল ক্ষেত্রে এই মাসালিহ এবং মাকাসিদগুলোর প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টি রাখা। তবে কোন বিষয়টা মাসলাহাত সেটা নির্ণয় করবে একমাত্র শরিয়ত ও তার নসসমূহ। কোন মানুষের অধিকার নেই যে, সে নিজের যৌক্তিকতাবোধ ও খেয়ালখুশির ভিত্তিতে মাসলাহাত নির্ধারণ করবে। কারণ এসব মাকাসিদ যেমন জীবন, সম্পদ এবং সম্মান রক্ষার মূলনীতি চূড়ান্ত না বা সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না। বরং মূল কথা হল ইমাম শাতেবী রহ. যা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘উপকার এবং ক্ষতি চিরন্তন না, বরং আপেক্ষিক। এক্ষেত্রে আপেক্ষিকতার অর্থ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন স্থান, কাল, পাত্রের জন্য উপকার ও ক্ষতি ভিন্ন ভিন্ন’।
এজন্য উপকার এবং ক্ষতি তাই যা আল্লাহর শরিয়াহ নির্ধারণ করেছে। ফলে এমন কোন উপকারিতা যা শরিয়ার কোন নসের সাথে বিরোধপূর্ণ তা বাস্তবে কোন উপকারিতা নয়। এগুলো হচ্ছে প্রবৃত্তির খাহেশ যা ধ্বংস করতেই শরিয়ার আগমন।
বর্তমান সময়ে কিছু মানুষ খুব জোরেশোরে মাকাসিদে শরিয়াহকে আঁকড়ে ধরার শ্লোগান দিচ্ছে এবং তারা নুসুসের উপর মাকাসিদে শরীয়াহকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তাদের যুক্তি হল, “শরিয়াহর বিধানগুলো মূলত এসকল মাকাসিদ অর্জনের জন্যেই এসেছে। ফলে যখন আহকামসমূহের আপাত ফলাফল মাকাসিদের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হবে তখন আমরা বাহ্যিক নসের উপর আমল না করে উল্লেখিত মাকাসিদগুলো অর্জনের চেষ্টা করবো।” এই ধরণের যুক্তি কাঠামো মূলত পুরো শরিয়াহকেই নাকচ করে দেয় এবং অনুমান নির্ভর ও আপেক্ষিক মাকাসিদের ভিত্তিতে আবদিয়্যাতের রশ্মিকেই ছিন্ন করে দেয়।
সত্য কথা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের জন্য দীনের যেসব বিধিবিধান দান করেছেন তা কোন না কোন উপকারী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই দিয়েছেন। তিনি কোন ক্ষতিকর বা উপকারহীন অপ্রয়োজনীয় বিধান আমাদের দেননি। কিন্তু মাকাসিদ এবং মাসালিহ কথাটা খুবই আপেক্ষিক। একজন মানুষ যেটাকে মাসলাহাত মনে করছে অন্যজন সেটাকে জীবনের জন্য মাসলাহ ও মাকসাদ নাও মনে করতে পারে। এজন্য ওহির সূত্র ছাড়া মানবীয় আক্বল এমন কোন সার্বজনীন মানদণ্ডে পৌঁছতে পারবে না, যেটা দিয়ে মাকাসিদ ও মাসালিহকে চিহ্নিত করা যাবে।
তাছাড়া শরিয়াহর মাধ্যমে চিহ্নিত মাকাসিদগুলোও চিরন্তন ও শ্বাশ্বত না। এগুলোর কিছু নির্দিষ্ট সীমা এবং নীতিমালা আছে। উদাহরণস্বরূপ প্রাণ রক্ষার কথাই ধরা যাক। নিশ্চয় এটা শরীয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাকাসিদের অংশ। কিন্তু একজন খুনি জীবন রক্ষার মাকাসিদের কথা বলে তার জীবন ভিক্ষা পাবেনা। একথা সকল মাকাসিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখন মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে এসকল মাকাসিদ নির্ধারণ কে করবে? এবং সে অনুযায়ী প্রায়োগিক শর্ত ও সীমাগুলো কে নির্ধারণ করবে?
আমরা যদি এই নির্ধারণ ক্ষমতাকে কেবল মানবীয় আক্বলের উপর ন্যস্ত করে দিই, তা হলে বড় বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। শরিয়াহ অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছে যা কেবল যৌক্তিকতা দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব না। যদি মানবীয় প্রজ্ঞা এসকল বিষয় সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হতো, তাহলে রাসুল ও ওহি প্রেরণের কোন দরকার ছিলো না। সত্য হচ্ছে কুরআন সুন্নাহকে এড়িয়ে এসকল মাকাসিদকে নির্ধারণের কোন উপায় নেই। তাই কোনভাবেই এসব আপেক্ষিক এবং দ্ব্যর্থবোধক মাকাসিদকে আমরা কোন পরিচ্ছন্ন আহকামের উপর প্রাধান্য দিতে পারিনা চাই সেই আহকাম কুরআন থেকে আহরিত হোক অথবা সুন্নাহ থেকে। আমাদের এই অধিকার নেই যে, আমরা এসকল মাক্বাসিদ ও মাসালিহকে শরীয়ার মৌলিক উৎস হিসেবে গ্রহণ করব এবং এগুলোর ভিত্তিতে শরীয়ার নুসুসকে ছুঁড়ে ফেলব।
মূলত মাসালিহ ও মাকাসিদ কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহ থেকেই আহরিত হবে। তাই আল্লাহ এবং রাসুলুল্লাহ (সা) যেটাকে কল্যান বলেছেন সেটাই একমাত্র কল্যান হিসেবে বিবেচিত হবে। নিজেদের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির খাহেশ অনুযায়ী কল্যান নির্ধারণ হবে না। মাকাসিদে শরিয়াহ বিষয়ক সকল আলিম যেমন আশ শাতেবি, ইমাম গাযযালি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ) তাঁরা সকলেই একমত যে, কোন হুকুম নির্ভর করে তার নিজস্ব ইল্লতের উপর, নিছক প্রজ্ঞার উপর না। তারা এ ব্যাপারেও একমত যে, যেসব মাকাসিদ নুসুসের সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলো কুরআনিক পরিভাষায় কেবল খাহেশাত ছাড়া আর কিছুই না।
মাকাসিদ বর্ননাকারিদের অগ্রদূত আল্লামা শাতেবি রহ. বলেন, শরিয়াহ এসেছে মানুষকে তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রকৃত গোলামে পরিনত করার জন্য। এই মূলনীতি যখন প্রতিষ্ঠিত তখন একথা বলা যায়না শরিয়াত সর্বদা মানুষের খাহেশাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবেই বিধানগুলি উপকারি হবে। আল্লাহ পাক সত্যিই বলেছেন, যদি হক তাদের খাহেশাতের অনুসরণ করতো তাহলে আকাশ এবং পৃথিবী এবং তাঁর মাঝে যা আছে সবকিছুতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতো।[১]
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) বলেন, ঠিক যেভাবে কোন সুন্নাহর উপর ইজমা হয়ে গেলে তাঁর উপর আমল ওয়াজিব হয়ে যায় ঠিক সেভাবে কোন বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ জারি করে এমন ওহিই সেই আদেশ নিষেধের উপর আনুগত্য বাধ্যতামূলক হওয়ার জন্য মহা গুরুত্বপুর্ন কারণ। এর ভিত্তিতেই (আল্লাহর) অনুগতদের পুরস্কৃত করা হবে, অবাধ্যদের লাঞ্ছিত করা হবে।সুন্নাহ এটাও আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করে যে যখন হাদিসের সনদ নিশ্চিত হয় তখন কোন হুকুম নুসুসের দ্বারা প্রমানিত হলে আমাদের জন্য বৈধ না আমলের ক্ষেত্রে এসকল মাকাসিদের উপর নির্ভর করা। [২][৩]
১) সূরা মুমিনুন- ৭১, আল মুওয়াফাকাত, ৬২
২) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাগ, ৩২-৩৩
৩) উসুলুল ইফতা ও আদাবুহু- ২৪৫ – ২৪৮
মূলঃ মুফতি তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ
অনুবাদঃ ইফতেখার সিফাত