মূল : ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি
অনুবাদ : মানসূর আহমাদ
সকল মাজহাবের ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, নারীদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পণ করা জায়েজ নেই; এই পদের জন্য প্রাথমিক একটা শর্ত হল তাকে পুরুষ হতে হবে।[১] এমনকি যারা নারীদের রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলেন এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতি জোর দেন, তারাও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে নারীদেরকে সমর্থন করেন না। এক্ষেত্রে তাঁরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ কেবল পুরুষের জন্যই; নারীর জন্য নয়।[২]
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই মতের প্রবক্তারা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পদকে ইসলামি শাসন ব্যবস্থার প্রধান নেতা (খলিফা)-এর পদের মতোই মনে করেন।[৩]
নারীর ক্ষমতায়নকে হারাম সাব্যস্তকারী উলামা-ফুকাহাগণ তাঁদের মতের বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস (শরয়ি যুক্তি)-এর মাধ্যমে দলিল দিয়ে থাকেন।
কুরআন
প্রথম দলিল: আল্লাহ তাআলা বলেন,
الرِّجَالُ قَوّٰمُونَ عَلَى النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلٰى بَعْضٍ وَبِمَآ أَنفَقُوا مِنْ أَمْوٰلِهِمْ ۚ
“পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল। এজন্য যে, আল্লাহ তাদের এককে অন্যের ওপর মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং এজন্য যে, পুরুষেরা তাদের ধন-সম্পদ হতে ব্যয় করে।”[৪]
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করার কারণ হল—
আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে পুরুষদেরকে নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল সাব্যস্ত করেছেন। আবার পুরুষেরাও একে অপরের ওপর কর্তৃত্বশীল। নির্দেশ প্রদান, সম্পত্তির আয়-ব্যয় ও শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরুষেরা কর্তৃত্বশীল। আর যে শাসন পরিচালনা করে, সেই ক্ষমতাশীল। কুরআনে ‘কাওওয়াম’ শব্দটা মুবালাগা তথা আধিক্য বুঝানোর জন্য এসেছে। অর্থাৎ, যে ভালোভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে।[৫]
সুতরাং আল্লাহ যেহেতু পুরুষদেরকে কর্তৃত্বের অধিকারী বানিয়েছেন; মহিলাদেরকে বানাননি, এজন্য শাসন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক বিষয়াদি পরিচালনা ও নেতৃত্ব কেবল পুরুষশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা ব্যাপক— রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক বিষয়-আশয়ে নেতৃত্ব দেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত। আর আমিরত্ব, মন্ত্রীত্ব ও খেলাফতের বিষয়টা এগুলোর সাথেই সম্পৃক্ত। তেমনিভাবে পারিবারিক বিষয়াবলি দেখভাল এবং পরিবারের সদস্যদের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও পুরুষেরাই ক্ষমতাবান। সুতরাং “পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল”— একথার অর্থ হল পুরুষেরা নারীদের সর্ববিষয়ের ব্যবস্থাপনা ও তাদের ভরণপোষণের দায়িত্বে নিয়োজিত এবং তাদের সুরক্ষা ও দেখভালের ব্যাপারেও দায়িত্বশীল। আর পুরুষের নির্দেশাবলি নারীদের ওপর কার্যকর। পুরুষেরাই শাসক হবে, আমির হবে। আর নারীদের ওপর আবশ্যক হল পুরুষেরা যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করতে বলছে না, ততক্ষণ তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।[৬]
এখানে আরেকটা বিষয়ও প্রমাণযোগ্য যে, কুরআন কিন্তু পুরুষদেরকে কেবল ঘরেই কর্তৃত্বশীল বলছে না। অর্থাৎ, আয়াতে ‘ঘরে’ শব্দ উল্লেখ করা হয়নি। যদি হত, তবে পুরুষদের ক্ষমতার বিষয়টা শুধু পারিবারিক জীবনেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত।[৭]
আল্লাহ তাআলা কিন্তু নারীদেরকে তাদের নিজ ঘরের ক্ষমতাও দেননি; পুরুষদেরকেই সেই ক্ষমতা দিয়েছেন। সুতরাং যাদেরকে নিজ ঘরের ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি, তাদেরকে কোটি কোটি ঘরের ক্ষমতা কীভাবে দেওয়া হবে![৮]
দ্বিতীয় দলিল: আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِى عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ ۗ
“স্ত্রীদেরও নিয়ম অনুযায়ী পুরুষদের ওপর অধিকার রয়েছে। আর নারীদের ওপর পুরুষদের রয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব।”[৯]
এই আয়াত দ্বারা দলিল দেওয়ার পদ্ধতি হল—
জাহিলিয়াতের যুগে নারীদেরকে যে অবহেলা করা হত, তাদের অধিকার ও ব্যক্তিত্বকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হত না, এখানে আল্লাহ তাআলা সেগুলোর বিরোধিতা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, মানবতার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষেরই মতো, পুরুষদের মতো উত্তম আচার-ব্যবহার তাদেরও প্রাপ্য। নারীদের অধিকার আদায় করা পুরুষদের ওপর আবশ্যক। তবে এখানে সমতা দ্বারা উদ্দেশ্য হল নারীদের ওপর পুরুষদের অধিকার রক্ষা করা যেভাবে আবশ্যক, তেমনিভাবে পুরুষদের ওপরও নারীদের অধিকার রক্ষা করা আবশ্যক। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে যে নারীদের সমান অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, এই আয়াতের মর্ম আদৌ সেটা নয়। কেননা, আল্লাহ তাআলা সাথে সাথেই বলে দিয়েছেন, “নারীদের ওপর পুরুষদের রয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব।” আর এই শ্রেষ্ঠত্বই কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা, যা আগের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং পুরুষেরা আদেশ দেবে, আর নারীরা তা মেনে চলবে।[১০]
তৃতীয় দলিল: আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفٰىهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُۥ بَسْطَةً فِى الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ ۖ
“আল্লাহ্ অবশ্যই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন।”[১১]
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করার পদ্ধতি—
আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার গুণাবলি বর্ণনা করেছেন। বনি ইসরাইলের লোকেরা তালুতকে বাদশাহ হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, তালুত তো রাজপরিবারের ছেলে না। তাছাড়া সে গরিব, তার সম্পত্তি নেই। (সুতরাং সে বাদশা হতে পারে না।) তখন আল্লাহ তাআলা তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, দুটো গুণের কারণে তালুত বাদশা হওয়ার উপযুক্ত— তার জ্ঞান বেশি এবং তার শরীরে শক্তি বেশি। এতে প্রমাণ হয় যে, জাতির নেতৃত্ব তার হাতেই অর্পণ করা হবে, যার রয়েছে প্রশস্ত জ্ঞান এবং শারীরিক শক্তি। যেন সে এই পদের ভার বহন করতে পারে।[১২] আর এটা তো জানা কথা যে, নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল, তারা পুরুষদের মতো যে কোনো ভার বহন করতে পারে না। আর এটা প্রাকৃতিক বিষয়— সৃষ্টিগতভাবেই তাদেরকে দুর্বল করে বানানো হয়েছে। সুতরাং তাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পণ করা যাবে না।[১৩]
সুন্নাহ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لن يفلح قوم ولوا أمرهم امرأة.
“সে জাতি কখনো সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসনভার কোনো স্ত্রীলোকের হাতে অর্পণ করে।”[১৪]
ইজমা (ঐকমত্য)
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে পুরুষ হওয়া শর্ত। ইসলামের প্রথম যুগের সাহাবা, তাবিয়িন সবাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। তাঁদেরই অনুসরণ করেছেন সব মাজহাবের ইমামগণ, ফুকাহায়ে কেরাম, উলামায়ে কেরাম, মুহাদ্দিসগণ ও মুফাসসিরগণ। সবাই ইজমা (ঐকমত্য পোষণ) করেছেন যে, নারীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণের যোগ্য নয় কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান নেতা (খলিফা) হিসেবে তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া জায়েজ নেই। তেমনিভাবে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও নারীদেরকে নির্বাচিত করা জায়েজ নেই। কারণ, প্রধানমন্ত্রীত্বের পদের জন্যও সেসব যোগ্যতা থাকা আবশ্যক, যেগুলো ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান নেতার জন্য আবশ্যক। এছাড়াও এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ-সুস্পষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে।
কিয়াস (শরয়ি যুক্তি)
নারীদের শারীরিক ও মানসিক গঠনের কারণে যুক্তি-বিবেকও একথাই বলে। (নারীদের দুর্বলতার কারণে তারা শাসনক্ষমতার যোগ্য নয়। তাছাড়া তাদেরকে তো নিজ ঘরের ক্ষমতাই প্রদান করা হয়নি। তাহলে কোটি কোটি ঘরের ক্ষমতা কীভাবে প্রদান করা হবে!) এক্ষেত্রে সহিহ বুখারির পূর্বোক্ত হাদিসের ওপর উত্থাপিত সব অভিযোগ প্রত্যাখাত। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। কেননা, উম্মতে মুসলিমা সর্বসম্মতিক্রমে এই হাদিস গ্রহণ করেছে। আর অভিযোগকারীদের উদ্দেশ্য কেবলই হাদিসে নববির ওপর সন্দেহ সৃষ্টি করা। উলামায়ে কেরামের মতের বিপরীতে পরে যে কথাটা বলা হয়েছিল, সেটারও কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক কোনো দলিল নেই। বরং এটা কিছু মানুষের গবেষণামূলক ভ্রান্তি। এটার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করা যাবে না, তাদের কর্ম দ্বারা দলিলও দেওয়া যাবে না।[১৫]
তথ্যসূত্র:
১. ওয়ালায়াতুল মারআতি ফিল ফিকহিল ইসলামি : ৮৩
২. প্রাগুক্ত : ৮৪
৩. প্রাগুক্ত
৪. সুরা নিসা : ৩৪
৫. তাফসিরে তাবারি : ৮/২৯০
৬. ওয়ালায়াতুল মারআতি ফিল ফিকহিল ইসলামি : ৮৫
৭. তাদবিনুদ দুসতুরিল ইসলামি : ৭১
৮. ওয়ালায়াতুল মারআতি ফিল ফিকহিল ইসলামি : ৯১
৯. সুরা বাকারা : ২২৮
১০. জামিউল বায়ান : ২/৪৫৪
১১. সুরা বাকারা : ২৪৭
১২. তাফসিরে রাজি : ৬/১৭৪; মাদারিকুত তানজিল : ১/১৬৩
১৩. ওয়ালায়াতুল মারআতি ফিল ফিকহিল ইসলামি : ৯৩
১৪. সহিহ বুখারি : ৭০৯৯ (আধুনিক প্রকাশনী :৬৬০৪; ইসলামিক ফাউন্ডেশন : ৬৬১৮)
১৫. ওয়ালায়াতুল মারআতি ফিল ফিকহিল ইসলামি : ১৬১
(দ্য ব্যাটালিয়ন বই থেকে)