মানসূর আহমাদ
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করে সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সংগত জীবন যাপনের পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদেরকে পৃথিবীর ফেতনা-ফাসাদ মোকাবিলায় সংগ্রামের নির্দেশ দিয়েছেন। দরুদ ও সালাম সেই মহামানবের প্রতি, যিনি আমাদের জন্য একটি উত্তম আদর্শ রেখে গিয়েছেন; যিনি কিয়ামত পর্যন্ত আগত মুসলিম উম্মাহর ওপর আপতিত সকল বিপর্যয় ও লাঞ্ছনা-অপদস্থতার কারণ বর্ণনা করে দিয়েছেন, সাথে সাথে তা থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন। সালাম বর্ষিত হোক সেসব মহামানবদের প্রতি, যাঁরা ইসলামের বিজয়ের জন্য, মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও গৌরব রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন।
মুসলমানরা শ্রেষ্ঠ জাতি, আল্লাহর কাছে সবচে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য জাতি। মুসলমানরা বীরের জাতি, বিজয়ী জাতি। একসময় বিশ্বের বড় বড় সকল পরাশক্তি মুসলমানদের শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, মুসলিম উম্মাহ বিজয়ী নয়! আজ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুসলিম উম্মাহ নির্যাতিত-নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, পরাজিত। এর কারণ কী? বীরের জাতির এমন অধঃপতন কী করে হল? যে জাতির নাম শুনলে কাফেররা থরথর করে কাঁপত, আজ তারাই কেন কাফেরদের ভয়ে কাঁপে? আজ তারাই কেন কাফেরদের হাতে মার খায়? কেন লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, পরাজিত হয়?
এসবের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল—
প্রথম কারণ: ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া
আল্লাহ তাআলার কিছু অলঙ্ঘনীয় অপরিবর্তনীয় মূলনীতি রয়েছে। আল্লাহ তাআলার একটা মূলনীতি হল, “যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনিও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করে দেবেন।” [১]
আল্লাহকে সাহায্য করার অর্থ হল তাঁর দীনের সাহায্য করা, তাঁর শরিয়ত বাস্তবায়ন করা, তাঁর দীন কায়েমের জন্য সংগ্রাম করা। আজ মুসলমানরা ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়েছে, শরিয়ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহকে সাহায্য করছে না। এমতাবস্থায় এই জাতিকে আল্লাহ কেন সাহায্য করবেন? কীভাবে তাদের বিজয় আসবে?
আজ মুসলমানদের কাছে ইসলামের কোনো মূল্য নেই। মুসলমানরা আজ খেলোয়াড়দের নাম জানে, নায়ক-নায়িকাদের নাম বলতে পারে, গান মুখস্থ করে, কিন্তু সাহাবিদের নাম জানে না, তাঁদের সংগ্রামের কাহিনি জানে না, কুরআনের দুয়েকটা সুরা মুখস্থ বলতে পারে না! আজ যে ব্যক্তি ইসলামের পক্ষে কথা বলে, তাকে যথাসম্ভব রাখঢাক করে, ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়। কিন্তু যে পাপাচার ও অবাধ্যতার পক্ষে কথা বলে, তাকে কোনো রাখঢাক করতে হয় না; সে সরাসরি তার পাপাচারের পক্ষে কথা বলে। যে জাতির পাপাচারীরা পাপাচার ও ঘৃণ্য কাজের পক্ষে কথা বলতে ভয় পায় না কিন্তু আলেমরা সত্য কথা বলতে ভয় পান, সে জাতিকে আল্লাহ তাআলা কেন সাহায্য করবেন?! আল্লাহ তাআলা বলেন, “মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে; যাতে ওদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি ওদেরকে আস্বাদন করানো হয়। যাতে ওরা (সৎপথে) ফিরে আসে।”[২]
উম্মুল মুমিনিন যাইনাব বিনতে জাহাশ রাযিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের মধ্যে পূন্যবান লোকজন থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে” (তখন সৎলোক থাকা সত্ত্বেও তোমরা ধ্বংস হবে)।[৩]
দ্বিতীয় কারণ: ভ্রাতৃপ্রেমের অভাব
মুসলমানরা একে অপরের ভাই। এমনকি সারাজীবন দেখা না হওয়া বিশ্বের এক প্রান্তের মুসলমানও অন্য প্রান্তের মুসলমানের ভাই৷ আল্লাহ তাআলা বলেন, “মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।”[৪]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মুসলমান মুসলমানের ভাই। তাই তোমরা পরস্পরকে হিংসা করো না, ঈর্ষান্বিত হয়ো না, কারও পেছনে লাগবে না; এবং তোমরা এক আল্লাহর দাস হয়ে যাও এবং হয়ে যাও একে অপরের ভাই।”[৫] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদের একটি দেহের মতো দেখবে। যখন দেহের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ নেয়।”[৬]
আজ মুসলমান একে অন্যের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ অনুভব করে না, একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে না, একে অন্যের দুর্দিনে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। সবাই শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। অন্য মুসলিম ভাই-বোনদের নিয়ে ভাবারও যেন ফুরসত নেই! অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের কেউ ততক্ষণ (প্রকৃত) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার (মুসলিম) ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।” [৭]
আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালেম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।” [৮]
তৃতীয় কারণ: পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত
ভ্রাতৃপ্রেম না থাকারই চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। যুগে যুগে মুসলমানরা কাফেরদের হাতে মার খাওয়ার ও পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিজেদের মধ্যে দ্বন্ধ-সংঘাত, বিভেদ-বিভাজন। মুসলিম বিশ্বের প্রায় সবকটা দেশই একটা অন্যটার সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। এমতাবস্থায় উদাহরণত আজ ফিলিস্তিনে কাফেরদের হামলা হলে সিরিয়া ফিলিস্তিনের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না বা আসবে না। তেমনিভাবে ইরাকে আক্রমণ হলে ইরান বা কুয়েত তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় তাদের শক্তি হ্রাস পেয়েছে। তাই কাফেররা তাদের ওপর অনায়াসে হামলা করছে।
এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কাফেররা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ না করলেও বা ব্যাপকভাবে ধ্বংসযজ্ঞ না চালালেও মুসলমানরাই একে অন্যের ওপর হামলে পড়ছে! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি আমার উম্মতের জন্য আমার রবের কাছে এ দোয়া করেছি, যেন তিনি তাদেরকে সাধারণ দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস না করেন এবং যেন তিনি তাদের ওপর নিজেদের ছাড়া এমন কোনো শত্রুকে চাপিয়ে না দেন, যারা তাদের দলকে ভেঙ্গে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিবে। এ কথা শুনে আমার পালনকর্তা বললেন, হে মুহাম্মাদ! আমি যা সিদ্ধান্ত করি, তা কখনো পরিবর্তন হয় না। আমি তোমার দোয়া কবুল করেছি। আমি তোমার উম্মতকে সাধারণ দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস করব না এবং তাদের ওপর তাদের নিজেদের ছাড়া অন্য এমন কোনো শত্রুকে চাপিয়ে দেব না, যারা তাদের সমষ্টিকে বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংস করতে সক্ষম হবে। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক একত্রিত হয়ে প্রচেষ্টা করে না কেন। তবে মুসলিমগণ নিজের মধ্যে পরস্পর একে অপরকে হত্যা করবে এবং একে অপরকে বন্দি করবে।” [৯]
আমরা প্রসিদ্ধ একটা কিচ্ছা জানি যে, এক ব্যক্তি অনেকগুলো পাটকাঠি জড়ো করে একসাথে আঁটি বেঁধে তার ছেলেদেরকে তা ভাঙতে বলেছিলেন। তারা ভাঙতে পারেনি। এরপর তিনি আঁটি খুলে তাদেরকে পাটকাঠিগুলো আলাদা আলাদা করে দিলেন৷ তখন তারা তা অনায়াসেই ভেঙে ফেলল। তিনি তার ছেলেদেরকে বললেন, তোমরা সবসময় ঐক্যবদ্ধ থেকো। তাহলে কেউ তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা আরেকটা রূপকথার গল্প জানি। গল্পটা চারটে মোটাতাজা গরুর। তারা যতদিন একসাথে ছিল, ততদিন বাঘ তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারেনি। কিন্তু যেই তারা নিজেদের মধ্যে বিভেদ করে আলাদা হয়ে গেল, অমনি বাঘ তাদের একটা একটা করে সবকটাকে খেয়ে ফেলল।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” [১০]
চতুর্থ কারণ: বিলাসিতা ও দুনিয়ায় মজে যাওয়া
তত্ত্বগতভাবে মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী এবং আল্লাহর কাছে দুনিয়ার কোনো মূল্য নেই। “দুনিয়ার মূল্য যদি আল্লাহর কাছে মাছির একটি পাখার সমমূল্য হত, তাহলে তিনি কোনো কাফিরকে এক ঢোকও পানি পান করতে দিতেন না।” [১১]
মুসলমানরা তত্ত্বগতভাবে এগুলো জানলেও তাদের বাস্তব জীবনের কর্মকাণ্ড এর বিপরীত। বর্তমানে মুসলমানরা বিলাসিতা ও দুনিয়ায় মজে গিয়েছে। যেন দুনিয়াই সবকিছু, দুনিয়ার জন্যই সবকিছু। আজ অনেক মুসলমান খাবারটা জুটাতে পারে না, তবুও তার সিগারেট ছাড়া চলে না! সন্তানাদির পোশাক কিনতে পারে না, তবুও সে ইন্টারনেট আর ক্যাফেটেরিয়ায় টাকা খরচ করে! বিলাসিতার চিত্র দেখলে মনে হয় মুসলমানদের যেন দুনিয়াই সব, যেন তাদেরকে মারা যেতে হবে না, যেন আখিরাত বলে কিছু নেই!! অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর।” [১২]
দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক ঝুঁকে পড়লে আল্লাহ তাআলা উম্মাহকে লাঞ্ছিত, অপদস্থ করেন— এটাই আল্লাহর রীতি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন তোমরা ইনা পদ্ধতিতে ব্যবসা করবে, গরুর লেজ আঁকড়ে ধরবে, কৃষিকাজেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং জিহাদ ছেড়ে দেবে, তখন আল্লাহ তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা ও অপমান চাপিয়ে দিবেন। তোমরা তোমাদের দীনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ তোমাদেরকে এই অপমান থেকে মুক্তি দেবেন না।” [১৩]
বিলাসিতা ধ্বংসের একটা স্পষ্ট কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করতে চাই, তখন সেখানকার সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদেরকে আদেশ করি, ফলে তারা সেখানে অসৎকাজ করে; অতঃপর সেখানকার প্রতি দণ্ডাজ্ঞা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি।” [১৪]
পঞ্চম কারণ: জিহাদ বর্জন
দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক ঝুঁকে পড়া ও বিলাসিতায় খুব বেশি ডুবে যাওয়ার ফলে মুসলমানরা জিহাদ ছেড়ে দিয়েছে। তারা আল্লাহর দেওয়া সংগ্রামের পথ ছেড়ে তথাকথিত শান্তির পথ বেছে নিয়েছে। অথচ এটা শান্তি নয়; এটা আত্মসমর্পণ, এটা বশ্যতা। যে কারণে দেখা যায়, মুসলমানরা সংগ্রাম করতে চাইলেই এই শান্তি বিঘ্নিত হয়ে যায়, কিন্তু কাফেররা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করলেও শান্তি বজায় থাকে!! মুসলমানরা কাফেরদের তথাকথিত শান্তির ফাঁদে পড়ে কাতরায়। অথচ কাফেররা সর্বাবস্থায়ই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে এবং থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তারা সবসময় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যে পর্যন্ত তোমাদেরকে তোমাদের দীন থেকে ফিরিয়ে না দেয়, যদি তারা সক্ষম হয়।” [১৫]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের বিরুদ্ধে (ইসলামবিদ্বেষী) অন্যান্য সম্প্রদায় একে অন্যকে আহবান করবে, যেরূপ খাবার বরতনের প্রতি ভক্ষনকারী অন্যান্যদেরকে ডেকে থাকে। বর্ণনাকারী বলেন, এটা শুনে সাহাবিদের কেউ বললেন, তা কি এজন্য হবে যে, আমরা সেই সময় সংখ্যায় কম হব? তিনি বললেন, (না) বরং তখন তোমরা সংখ্যায় অনেক বেশি হবে, কিন্তু তোমাদের অবস্থা হবে স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার ন্যায়। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের অন্তরে ‘ওয়াহন’ সৃষ্টি করে দেবেন। তখন কোনো একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ‘ওয়াহন’ কী? তিনি বললেন, দুনিয়ার মহব্বত এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।[১৬]
মুসনাদে আহমাদের রিওয়ায়াতে এসেছে, “দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং যুদ্ধ-জিহাদকে অপছন্দ করা।” [১৭]
পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, (খুব সম্ভব) সব দেশেরই আলাদা আলাদা সেনাবাহিনী রয়েছে, পৃথক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। কারণ, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যতীত কোনো দেশই শত্রু থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে না; যে কোনো সময় তাদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। তেমনিভাবে জিহাদও ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। জিহাদ-সংগ্রাম ছাড়া মুসলমান নিরাপদ থাকতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে জাতি জিহাদ ছেড়ে দেবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শাস্তির অন্তর্ভুক্ত করবেন।” [১৮]
আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে নবী, আপনি মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করুন।” [১৯] “হে ইমানদারগণ! কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের কাছাকাছি, তাদের সাথে যুদ্ধ করো এবং তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। আর জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথে আছেন।” [২০] “আর তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করো, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে।”[২১] কুরআনে এমন আয়াত প্রচুর রয়েছে। সুতরাং মুসলমানদের জন্য জিহাদ ছেড়ে তথাকথিত শান্তির পথ বেছে নেওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যদি তোমরা (যুদ্ধে) বের না হও, তবে তিনি তোমাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক কওমকে আনয়ন করবেন। আর তোমরা তাঁর কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।”[২২]
ষষ্ঠ কারণ: জিহাদ ও লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে অবহেলা
বর্তমান মুসলমানরা নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তথা জিহাদ যেমন ছেড়ে দিয়েছে, তেমনি এর প্রস্তুতিও ছেড়ে দিয়েছে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা তাদের (মোকাবিলার) জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সুসজ্জিত অশ্ব প্রস্তুত রাখ। এ দিয়ে তোমরা আল্লাহর শত্রু তথা তোমাদের শত্রুকে সন্ত্রস্ত করবে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে, যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ জানেন। আর আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করবে, তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি অত্যাচার করা হবে না।” [২৩]
আজ মুসলমানরা গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকাদের পেছনে টাকা ঢালছে, খেলাধুলা ও অনর্থক হাসিতামাশায় টাকা খরচ করছে; কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি ছেড়ে দিয়েছে, বিজয়ের উপায়-উপকরণ গ্রহণ করছে না। ইতিহাস অধ্যয়নে আমরা দেখতে পাই, যে যুগেই মুসলমানরা লড়াইয়ের প্রস্তুতির ব্যাপারে অবহেলা করেছে, সে যুগেই তারা শত্রুর মার খেয়েছে। এটা আল্লাহ তাআলার একটা রীতি— যে চেষ্টা-সাধনা করে, আল্লাহ তার চেষ্টা-সাধনাকে বিফল করেন না। যে শক্তির উপাদান সঞ্চয় করে, বিজয়ের উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে, আল্লাহ তাকে বিজয় দান করেন। “যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন ও তার জৌলুস কামনা করে, আমি সেখানে তাদেরকে তাদের আমলের ফল পুরোপুরি দিয়ে দেই এবং সেখানে তাদেরকে কম দেওয়া হবে না।” [২৪]
সপ্তম কারণ: যোগ্য ও আদর্শবান নেতৃত্বের অভাব
আজ মুসলমানদের আদর্শবান কোনো নেতা নেই। এমন কেউ নেই, যার ডাকে পুরো মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হবে। বর্তমান মুসলমানদের প্রায় সব নেতাই মুনাফিক, পথভ্রষ্ট, দূর্নীতিগ্রস্ত, আদর্শহীন ও জালেম। আল্লাহ তাআলার একটা নিয়ম হল— মুনাফিক ও ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের হাতে উম্মাহর বিজয় আসে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের কাজ সার্থক করেন না।”[২৫]
আদর্শবান নেতা ছাড়া মুসলমানদেরকে যতই ওয়াজ-নসিহত করা হোক, যতই যুদ্ধ ও বীরত্বের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হোক, কোনো লাভ হবে না। আদর্শবান, যোগ্য লোকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করাটা কিয়ামতের আলামত। যোগ্যতা না দেখে শুধু ঘুষ আর মামু-খালুর সহায়তায় ক্ষমতাসীন করা, নেতৃত্ব প্রদান করা মুসলমানদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “এক গ্রাম্য সাহাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিয়ামত কখন হবে?’ জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বললেন, ‘যখন আমানত নষ্ট করা হবে, তখন তুমি কিয়ামতের প্রতীক্ষা করো।’ সাহাবি জানতে চাইলেন, ‘কীভাবে আমানত বিনষ্ট হবে?’ তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যখন অনুপযুক্ত লোকের কাছে নেতৃত্ব অর্পণ করা হবে, তখন তুমি কিয়ামতের প্রতীক্ষা করো।”[২৬] যখন দায়িত্বগুলো এমনসব লোককে দেওয়া হবে, যারা যোগ্যও না, আমানতদারও না; কেবল কারও মাধ্যমে, আত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিতে কিংবা ঘুষের মাধ্যমে সেই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তবে জেনে রেখো, বিজয় অনেক দূরে। [২৭]
অষ্টম কারণ: উম্মাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব
বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে এই ব্যাধিটা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানরা আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা তথা আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্যই শত্রুতা— এই গুরুত্বপূর্ণ আকিদাটা ভুলে গিয়েছে। আজ তারা নিজেদের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে। শান্তিচুক্তির নামে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।” [২৮] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “মুমিনরা যেন মুমিনদের ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধু না বানায়। আর যে কেউ এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।”[২৯]
মুনাফিকশ্রেণির শাসকরা শান্তির দাঁড়কাক কাফেরদের কাছে শান্তিচুক্তির জন্য ছুটে বেড়ায়। অথচ এগুলো শান্তিচুক্তি নয়; প্রকৃতপক্ষে আত্মসমর্পণ, বশ্যতা স্বীকার। আল্লাহ তাআলা বলেন, “সুতরাং তুমি দেখতে পাবে, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তারা কাফিরদের মধ্যে (বন্ধুত্বের জন্য) ছুটছে। তারা বলে, আমরা আশঙ্কা করছি যে, কোন বিপদ আমাদেরকে আক্রান্ত করবে। অতঃপর হতে পারে আল্লাহ দান করবেন বিজয় কিংবা তাঁর পক্ষ থেকে এমন কিছু, যার ফলে তারা তাদের অন্তরে যা লুকিয়ে রেখেছে, তাতে লজ্জিত হবে।” [৩০]
মুনাফিকশ্রেণির শাসকরা মনে করে, কাফেরদের সাথে তথাকথিত শান্তিচুক্তি করে দিব্যি আরামে থেকে যাবে, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাবে, কাফেররা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা কখনোই তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ কর।” [৩১] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “তারা কামনা করে, যদি তোমরা কুফরি করতে (কাফের হয়ে যেতে) যেভাবে তারা কুফরি করেছে। অতঃপর তোমরা সমান হয়ে যেতে।।” [৩২]
নবম কারণ: হতাশা ও মনোবলহীনতা
বর্তমানে মুসলমানরা চরম পর্যায়ের হতাশ ও মনোবলহীন, মুসলমানদের আত্মবিশাসের খুবই অভাব। মুসলমানরা কোনোরূপ চেষ্টা-সাধনা ছাড়াই, প্রতিরোধের প্রস্তুতি ছাড়াই কাফেরদের হাতে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছে। এটাকে মানসিক দাসত্ব বলা যায়। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে বিজয়ের এবং অধঃপতন থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনাই দেখছে না। অথচ হতাশা ও মনোবলহীনতা মুমিনদের গুণ নয়; বরং এগুলো কাফেরদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “কেননা কাফির সম্প্রদায় ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।”[৩৩]
আত্মবিশ্বাস ও মনোবল ছাড়া মুসলমানদের বিজয় আসবে না, অধঃপতন থেকে উত্তরণ হবে না। তাতার-যুগের মুসলমানদের ইতিহাসে দেখা গেছে, তারা এই মনোবলহীনতার শিকার হওয়ার ফলে, এই দাসত্ব মেনে নেওয়ার ফলে মাত্র একটা তাতার শত শত মুসলমানকে হত্যা করেছে। এমনকি এমনও হয়েছে, এক তাতার-সেনা তরবারি আনতে ভুলে গেছে। সে মুসলমানকে রাস্তায় মাথা নিচু করে বসে থাকার নির্দেশ দিল। মুসলমান লোকটাও ওভাবেই মাথা নিচু করে বসে থাকল, তবু পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটুকু করল না। পরে তাতারটা তরবারি নিয়ে এসে তাকে হত্যা করে দিল। এমনও হয়েছে, একটা তাতার এক সড়কে এল। সেখানে আঠারোজন মুসলিম ছিল। তাতারটা তাদেরকে একে অন্যকে বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিল। আর আঠারোজন মুসলিম মাত্র একটা তাতারকে প্রতিরোধ করার পরিবির্তে একে অন্যকে বেঁধে ফেলতে শুরু করল![৩৪] এতটা অধঃপতন, এতটা মানসিক পরাজয়, এতটা মনোবলহীন হলে কখনোই মুসলমানদের বিজয় আসবে না; কাফেরদের মার খেয়ে বেঘোরে মরতে হবে।
দশম কারণ: যথাযথ শুরাব্যবস্থা না থাকা
মুসলমানদের শাসন পরিচালনার অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে শুরা পরিষদ। শুরাব্যবস্থা ছাড়া একনায়কতন্ত্র কায়েম করা ইসলামি শরিয়ত-বিরোধী। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, “আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।” [৩৫]
এই হল মুসলমানদের অধঃপতিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত হওয়ার প্রধান কয়েকটি কারণ। এগুলো মুসলিম উম্মাহর ব্যাধি। ব্যাধিগুলো একটা অন্যটার সঙ্গে অনেকাংশেই সম্পৃক্ত। একটা থেকে মুক্তি পেলে অন্যটা থেকেও মুক্তি পাওয়া সহজ। আর একটায় আক্রান্ত হলে অন্যটায় আক্রান্ত হয়ে যাওয়াও স্বাভাবিক। আমাদের উল্লেখকৃত মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের এই কারণগুলোর প্রতিকারই বিজয়ের পথ, অধঃপতন থেকে উত্তরণের পথ। এগুলোর বাস্তবিক চিকিৎসা করতে হবে।
আমাদের ওপর আবশ্যক হল, এগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করা, নিজেদের মধ্যে সমস্যাগুলো আছে বলে বিশ্বাস করা, এগুলোর প্রতিকারে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা এবং বিশ্বের বুকে মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য সব ধরনের শক্তি ব্যয় করা। অধঃপতনের কারণগুলো দূর করা বা উত্তরণের জন্য আমরা যা করবো—
১. আল্লাহ তাআলা ও তাঁর শরিয়তের দিকে পূর্ণরূপে প্রত্যাবর্তন।
২. দীনের ওপর ভিত্তি করে সমস্ত মুসলমানের মধ্যে একতা। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভাই-ভাই সম্পর্ক গড়ে তোলা।
৩. জান্নাতের ব্যাপারে পূর্ণ ইমান ও দুনিয়াবিমুখতা অর্জন এবং বিলাসিতা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে দূরে থাকা।
৪. জিহাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও উৎসাহপ্রদান এবং যুবকদেরকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধকরণ।
৫. অস্ত্রশস্ত্র, জ্ঞান-বিজ্ঞান, পরিকল্পনা, অর্থনীতি ও সামরিক ট্রেনিং ইত্যাদির মাধ্যমে বস্তুগত প্রস্তুতির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ।
৬. মহান আদর্শবান নেতৃত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটানো এবং মুসলমানদের কাছে ইসলামের মূল প্রতীকগুলো ও এর সম্মান তুলে ধরা।
৭. উম্মাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্বহীনতা এবং শত্রু-মিত্রের মাঝে পার্থক্য করার জন্য বাস্তবিক বুঝশক্তি ও চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করা।
৮. মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আশার সঞ্চার করা এবং তাদের সাহসিকতা ও মনোবল বৃদ্ধি করা।
৯. যোগ্য লোকের কাছে দায়িত্ব ও নেতৃত্ব অর্পণ।
১০. সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বাস্তবিক শুরাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং একনায়কতন্ত্র বাদ দিয়ে শুরা পরিষদের প্রত্যেক সদস্যের মতামতকে যথাযথ মূল্যায়ন।
১১. বিজয়ী দলের গুণাবলি অর্জন করা। বিজয়ী দলের গুণাবলির মধ্যে রয়েছে—
ক. হককে আঁকড়ে ধরা এবং হকের অনুসরণ করা; বেশিরভাগ মুসলমান যা করছে, সেটার অনুসরণ না করা। বেশিরভাগ মানুষই যখন হক থেকে বিমুখ হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে উপদেশ দেওয়া এবং নিজে হকের ওপর অটল থাকাই বিজয়ী দলের কাজ।
খ. সুদৃঢ় আকিদা-বিশ্বাসের অধিকারী হওয়া। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণের আদর্শকে আবশ্যিকভাবে পালন করা এবং বিদআত ও বিদআতিদের থেকে দূরে থাকা।
গ. হিদায়াত, বাহ্যিক পরিশুদ্ধি ও আত্মশুদ্ধিতে অবিচল থাকা এবং পাপাচার, সন্দেহ-সংশয় ও হারাম কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাকা।
ঘ. নিজের জান-মালের মাধ্যমে জিহাদ, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজ থেকে নিষেধ এবং কর্মীদের ওপর হক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও অবিচল-অনড় থাকা।
ঙ. নিজেদের আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোটাই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইসলামের বিজয়ের উদ্দেশ্যে করা। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের দায়িত্ব পালন করা। বিজয়ী দলের গুণাবলি সম্পর্কিত হাদিসে এসেছে, “তারা সত্যের পক্ষে বা আল্লাহর হুকুমের পক্ষে লড়াই করতে থাকবে।” [৩৬]
চ. ধৈর্যশীল হওয়া, ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে সবকিছু মোকাবিলা করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজয়ী দলের বর্ণনায় বলেছেন, “যারা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চাইবে কিংবা বিরোধিতা করবে, তারা এদের (বিজয়ী দলের) কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং এরা বিরোধীদের কোনো পরোয়াও করবে না।”[৩৭] প্রিয়নবির এ পবিত্র বর্ণনায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সাহায্যপ্রাপ্ত দলের এসব কর্মী নিজেদের লক্ষ্য চিনে নেবে, নিজেদের পথ বেছে নেবে এবং বিরোধীদের বিরোধিতা, পরিত্যাগকারীদের প্রতিবন্ধকতা কিংবা হিংসুক শত্রুদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবে না। তারা ধৈর্য, স্থিরতা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে যে কোনো সমস্যা মোকাবিলা করবে।[৩৮]
সাহায্যপ্রাপ্ত বা বিজয়ী দলের সাথে সম্পৃক্ত এসব গুণাবলি কোনো শ্লোগান বা দাবি নয়; বরং এগুলো বাস্তবায়ন ও কার্যে পরিণত করার বিষয়, তাদের শরয়ি গুণাবলি নিশ্চিত করার বিষয় এবং তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করার বিষয়। যে এসব গুণ অর্জন করে নেবে এবং দায়িত্ব পালন করবে, সে-ও সাহায্যপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হবে, যদিও সে একা হয়। আল্লাহ বলেন, “হে ইমানদারগণ, তোমরা যা করো না, তা বলো কেন? তোমরা যা করো না, তোমাদের তা বলা আল্লাহর নিকট অতিশয় অসন্তোষজনক। যারা আল্লাহর পথে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো সারিবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।” [৩৯]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মুসলমানদের সকল দুর্বলতা-দুরবস্থা থেকে বাঁচিয়ে, সকল আত্মিক ব্যাধি ও গাফলতি থেকে মুক্ত করে পৃথিবীর বুকে আবারও সঠিক ইসলামি শাসন কায়েমে জিহাদ-সংগ্রাম করার এবং মুসলমানদের ওপর চলা সকল নির্যাতন-নিপীড়ন ও আগ্রাসন মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করার তাওফিক দিন। আমীন।
[ড. রাগিব সারজানি রচিত কিসসাতুত তাতার অবলম্বনে]
তথ্যসূত্র:
১) সুরা মুহাম্মাদ : ৭
২) সুরা রুম : ৪১
৩) সহিহ বুখারি : ৩৩৪৬; সহিহ মুসলিম : ২৮৮০
৪) সূরা হুজুরাত: ১০
৫) সহিহ বুখারি : ৫৬৩৮
৬) সহিহ বুখারি : ৬০১১; সহিহ মুসলিম : ২৫৮৬; মুসনাদে আহমাদ : ১৮৪০১
৭) সহিহ বুখারি : ১৩; সহিহ মুসলিম : ৭৫
৮)সুরা নিসা : ৭৫
৯) সহিহ মুসলিম : ৭১৫০
১০) সুরা আনফাল : ৪৬
১১)সুনানে তিরমিজি : ২৩২০; মিশকাতুল মাসাবিহ : ৪৯৫০
১২) সুরা নিসা : ৭৮
১৩) সুনানে আবু দাউদ : ৩৪৬২
১৪) সুরা ইসরা : ১৬
১৫)সুরা বাকারাহ : ২১৭
১৬) সুনানে আবু দাউদ : ৪২৯৭
১৭) মুসনাদে আহমাদ : ৮৭১৩
১৮) সহিহ আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব : ১৩৯২
১৯)সুরা আনফাল : ৬৫
২০)সুরা তাওবাহ : ১২৩
২১) সুরা তাওবাহ : ৩৬
২২)সুরা তাওবাহ : ৩৯
২৩) সুরা আনফাল : ৬০
২৪ সুরা হুদ : ১৫
২৫)সুরা ইউনুস : ৮১
২৬) সহিহ বুখারি : ৫৯
২৭)কিসসাতুত তাতার, ড. রাগিব সারজানি : ৩৫৭
২৮) সুরা মায়িদাহ : ৫১
২৯)সুরা আলে ইমরান : ২৮
৩০)সুরা মায়িদাহ : ৫২
৩১) সুরা বাকারাহ : ১২০
৩২)সুরা নিসা : ৮৯
৩৩)সুরা ইউসুফ : ৮৭
৩৪)কিসসাতুত তাতার, ড. রাগিব সারজানি : ৮৬
৩৫)সুরা আলে ইমরান : ১৫৯
৩৬)সহিহ মুসলিম : ১৭৬; সুনানে আবু দাউদ : ২৪৮৪
৩৭)সহিহ বুখারি : ৭৪৬০
৩৮)সিফাতুল গুরাবা, সালমান আল-আওদাহ : ২০৫
৩৯)সুরা সফ : ২-৪